পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের বিষয় উল্লেখ করে বছরের পর বছর বন্ধ রয়েছে সিলেটের ভোলাগঞ্জ, জাফলং ও বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি।
শ্রমিক ও ব্যসায়ীদের দাবি, সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করতে হাইকোর্টের আদেশ থাকলেও কী কারণে এসব পাথর কোয়ারি বন্ধ রয়েছে এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর তারা কারো কাছ থেকে পাননি। ।
গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা জানান, সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের বিষয়ে হাইকোর্টরের আদেশের কপি নিয়ে নিয়মিত প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন। তবে প্রশাসনের কার্যকরি পদক্ষেপ না পেয়ে হতাশ হয়েছেন তারা।
পাথরগুলো কয়েক বছর ধরে বন্ধ থাকায়, কোয়ারি সংশ্লিষ্ট শ্রমজীবী দিনমজুররা কর্মসংস্থান হারিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধহারে দিনযাপন করছেন। কর্মক্ষেত্র বন্ধ থাকায় পাথর, বালু ও বারকি শ্রমিকদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে।
প্রতিদিন ভোরে সাজের সন্ধানে বেলচা, টুকরি নিয়ে তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন তারা। দেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারি সিলেটের জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ ও শ্রীপুরসহ সব কয়টি এলাকায় কোয়ারি ও বালু মহালের সংশ্লিষ্ট কয়েক লাখ শ্রমিকের বর্তমান অবস্থা এমনই।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, কোয়ারি ও বালু মহাল সচল থাকলে সরকারের বড় অংকের রাজস্বও আদায় হতো। পাশাপাশি সিলেটসহ সারাদেশের ৩-৪ লাখ শ্রমিক কাজ করে নিজের জীবনযাপন করতে পারতেন। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতি আরও মজবুত হতো।
শুধু পাথর, বালু ও বারকি শ্রমিক নয়, বেকায়দায় পড়েছেন এবার পাথর ব্যবসায়ীরাও। তারা জানান, শেষ সম্বল টুকু ব্যাংকে বন্ধক রেখে কিনেছেন পাথর ভাঙার যন্ত্র (ক্রাশার মিল)। কোয়ারি বন্ধ থাকায় ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতেও পারছেন না। হারাতে বসেছেন তাদের শেষ সম্বল টুকু।
পাথর ব্যবসায়ীরা অপেক্ষায় বসে আছেন কোয়ারি খোলার। দীর্ঘ দিন থেকে কোয়ারি ও বালু মহাল থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় পাথরের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বেকার হয়ে পড়েছেন। বন্ধ হতে চলেছে জাফলং, ধূপাগুল, ভোলাগঞ্জসহ উত্তর সিলেটের ক্রাসিং জোন এলাকা। কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় ওই সব ক্রাশার এলাকা শ্রমিক শূন্য হয়ে পড়েছে দিন দিন।
এদিকে দীর্ঘদিন একই পেশায় নিয়োজিত থেকে অন্য কোনো কাজ করতেও পারছেন না তারা।
এর মধ্যে বেশ কয়েকবার শ্রমিকেরা কোয়ারি খোলার দাবিতে নানা ধরনের আন্দোলনও করেছেন। এছাড়া জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ ও শ্রীপুরের ব্যবসায়ী নেতারা পাথর কোয়ারি সচলের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন।
শুধু শ্রমিক ও পাথর ব্যবসায়ীই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন পরিবহন শ্রমিক-মালিকরাও।
এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম শাখার ট্রাক-পিক আপ-কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হাফিজুর রহমান বলেন, এ এলাকায় প্রায় দুই হাজার ট্রাক পাথর পরিবহন করে। বর্তমানে ট্রাক মালিক ও শ্রমিকরাও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পাথর কোয়ারি খুলে দিলে সরকার যেমন রাজস্ব পাবে, তেমনি শ্রমজীবীরাও পেটের ভাত পাত পাবে।
বিছন্নাকান্দির পাথর ব্যবসায়ী মহিবুর রহমান বলেন, সোনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তলনের জন্য কোয়ারি খুলে দিলে এলাকার ব্যবসায়ী ও পাথর সংশ্লিষ্ট সবার জীবিকার ও কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচন হবে। অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংকে বন্ধক রাখা সম্পত্তি ফিরে পাবেন। এবার সেই কোয়ারিগুলো থেকে পরিবেশ সম্মতভাবে পাথর উত্তোলনের সুযোগ করে দেওয়া জরুরি।
এ ব্যাপারে জাফলং পাথর কোয়ারি এলাকার ব্যবসায়ী মিনহাজ উদ্দিন বলেন, পাথর ও বালু উত্তোলন বন্ধ থাকার কারণে কোয়ারি এলাকার শ্রমিকদের মধ্যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ক্রমেই কর্মহীন মানুষের হাহাকার বাড়ছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ইজারা বিহীন কোয়ারি এবং যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় জাফলং, বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি ও বালু মহাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাথর কোয়ারি বন্ধ রাখতে উপজেলা প্রশাসন থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
এদিকে দীর্ঘ ৬ বছর বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের করা রিট পিটিশনের ভিত্তিতে হাইকোর্ট সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে জাফলংয়ের ব্যাপারে ২২ অক্টোবর, বিছনাকান্দির ১১ নভেম্বর ও ভোলাগঞ্জের ব্যাপারে ১৪ নভেম্বর পাথর উত্তোলনের নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরাও একই কথা জানিয়েছেন।
তবে এ বিষয়ে তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আমার কাছে তথ্য আছে পাথর কোয়ারি বিষয়ে হাইকোর্টর আদেশ চেম্বার কোর্টে স্থগিত করা হয়েছে।
এদিকে গোয়াইনঘাট উপজেলার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন, পাথর ও বালু শ্রমিকদের মানবেতর জীবন বিবেচনা করে পাথর কোয়ারিগুলো জরুরি ভিত্তিতে খুলে দিতে।